জামান মৃধা, ডিমলা (নীলফামারী):
উচ্চ আদালত ও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশনার পরও থামছে না অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। কোন ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদী, নাউতারা নদীসহ অন্যান্য নদীর ভূগর্ভস্থ থেকে শ্যালো মেশিন (রূপান্তরিত) বোমা মেশিনের সাহায্যে বালু উত্তোলন করছে একটি প্রভাবশালী মহল।
নদীর পাড়ে বালুর স্তুপ করার ফলে নষ্ট হচ্ছে পাড়ের ফসলি জমির উর্বরতা। এমনকি ট্রাক, ট্রাক্টর, এস্কাভেটর (ভেকু) ও মেশিন নদীর তীরে নেয়ার জন্য নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধটিও নির্বিচারে কাটছে তারা। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও স্থাপনার আশ পাশেই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় সরকারি নিয়মনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অবৈধভাবে তিস্তানদীর ভূগর্ভস্থ থেকে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। প্রশাসনকে জানালে মিলে দায়সারা উত্তর আসতেছি, দেখতেছি, দেখবো অথবা ভূমি কর্মকর্তাকে পাঠাচ্ছি!
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন ও পাউবো কর্মকর্তাদের নীরবতায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। তারা বলছেন প্রশাসনের নিকট একাধিকবার অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার মিলছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিজেল ইঞ্জিনকে বোমা মেশিনে রূপান্তরিত করার ফলে বিকট শব্দে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বিরক্ত হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দা, স্কুল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এবং অসুস্থ মানুষজন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সোমবার (২৩ অক্টোবর) উপজেলার পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়নের ১ নং স্পার সংলগ্ন ওমর পাড়া গুচ্ছগ্রামে নদীর তীররক্ষা বাঁধ সংস্কারের নামে সিক্স সিলিন্ডার বোমা মেশিন বসিয়ে অবাধে চলছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। আর নিষিদ্ধ ঘোষিত এ বোমা মেশিন চালানোর হুকুমদাতা নাউতারা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান আশিক ইমতিয়াজ মোর্শেদ (মনি) এমনটিই জানিয়েছে ওই মেশিনের কর্মচারী আমিনুর রহমানসহ অন্যান্যরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, এভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করলে আমাদের অবাদি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়াও মেশিনের উচ্চমাত্রার শব্দে আমার বাচ্চার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। নদীর তীররক্ষা বাঁধের সংস্কারের কথা বলে বালু উত্তোলন করা হলেও তা না করে পাশের পরিত্যক্ত পুকুর ভরাটসহ আশপাশের বাড়ি ঘরেও দেওয়া হচ্ছে বালু। আর সামান্য কিছু বালু জিও ব্যাগে ভরাটের জন্য স্তুপ করে রাখা হয়েছে। ওই মেশিনে কর্মরত আমিনুর রহমানকে মেশিন মালিকের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করে লাভ হবে না! আসছেন ভিডিও করে চলে যান!
তিনি আরো বলেন, এটা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ। মেশিন চালানোর অনুমতি রয়েছে। এটা চেয়ারম্যানের মেশিন। আর কাজও তার। তার নির্দেশেই সরকারি কাজে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আপনার কিছু বলার থাকলে চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলেন!
নাউতারা ইউপি চেয়ারম্যান আশিক ইমতিয়াজের সাথে বোমা মেশিন চালানোর বিষয়ে কথা হলে তিনি বলেন, আমি ওই কাজের ঠিকাদার নই। আচ্ছা আগে বলেন তো ওখানে কেন মেশিন চলছে? পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষে হতে লোকাল অ্যারেজমেন্টের মাধ্যমে কাজটা করতে হবে। পরে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন প্রজ্ঞাপনের কথা বললে চেয়ারম্যান বলেন, ওখানে গিয়ে আপনারা যদি এসব কথা বলেন। তাহলে বলেন! লিখেন! তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। আর আমার কিছু বলারও নেই।
চেয়ারম্যান আরো বলেন, যে কাজটা চলছে, ওই এলাকাটি ভেঙ্গে গেছে। এটা আপনারা, সাংবাদিকরা একটি বারও লিখলেন না! নিউজ করলেন না তো! এখানে মূলত শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি। আর নদী পাড়ের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। সেই কারণে নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করে জিও ব্যাগে বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বোমা মেশিনের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত। এছাড়াও বালু মহাল এবং মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ সালের নীতিমালা অনুযায়ী পাম্প বা অন্য কোন মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাইবে না। ওই আইনের (৩) উপ-ধারা (২) এ উল্লেখ রয়েছে ড্রেজিং কার্যক্রম বাল্কহেড বা প্রচলিত বলগেট ড্রেজার ব্যবহার করা যাইবে না। এবং সর্বোপরি এভাবে বালু উত্তোলন আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচ্য হবে। এছাড়াও ২০১৯ সালের ১৭ই জুন (সোমবার) মহামান্য হাইকোর্ট বলেছেন ”নদী থেকে বালু উত্তোলন বন্ধের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে না পারলে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চাকরি ছেড়ে দিতে”। বিশ্বব্যাপী নদীর আইনগত সত্তা ধারণার সূচনা হয়েছে কলম্বিয়ার আদালতের একটি রায় থেকে। নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ বিশেষ নদীকে লিগ্যাল পারসন ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১৭ সালের মার্চ মাসে ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ে গঙ্গা ও যমুনা নদীসহ বাস্তুতন্ত্রকে জীবন্ত মানুষের মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের ২০১৯ সালের একটি রায়ে দেশের নদীগুলোকে জুরিসটিকপারসন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামের সংগঠনের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তুরাগ নদীকে লিভিং এনটিটি ঘোষণা করা হলেও পরে দেশের সব নদীর ক্ষেত্রে এ রায় বহাল রাখা হয়েছে। ফলে মানুষের যে সমস্ত আইনি অধিকার রয়েছে, এসব নদীরও তেমনি আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অবৈধ বালু উত্তোলনসহ অন্যান্য দূষণ থেকে নদীকে বাঁচাতে যুগান্তকারী এ রায় দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সেতু, কালভার্ট, রেললাইনসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এক কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করা বেআইনি।
এ বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা জানান, আমি মিটিংয়ে ঢাকায় আছি। লোক পাঠাচ্ছি। এরপর তিনি আর ফোন ধরেননি।
জেলা প্রশাসক নীলফামারী পঙ্কজ ঘোষ বলেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়েছি। আশা করছি বোমা মেশিনের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে।